APPS EARN Monetization Withdraw Telegram

গল্পঃ অবৈধ সন্তান

bina avatar   
bina
পর্বঃ_০১

আজ আমার স্ত্রীর মেয়ের বিয়ে। যতবারই মেয়ের শ্বাশুড়ীর সামনে যাচ্ছি, ততবারই আমার গলা শুকিয়ে হাত পা কেঁপেঁ কেঁপেঁ উঠছে। মুখ মলিন হয়ে যাচ্ছে। একবারও তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছি না। অথচ এ চোখে চোখ রেখে কত সময় পার করে দিতাম।

 

আমার স্ত্রী রোকেয়া অনেক বার বলেছিল ছেলের বাসায় গিয়ে তার বাবা মা ভাইয়ের সাথে আলাপ পরিচয় হয়ে আসতে। আমি পাত্তা দেইনি। মেয়ের যেহেতু পছন্দ তাই বাসায় যাওয়ার ঝামেলায় আমি যাইনি। ওসব কিছু রোকেয়াই সামলিয়েছে।

 

রোকেয়া আমাকে মেয়ের শ্বাশুড়ীর (জয়া) কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। জয়া খুব স্বাভাবিকভাবে আমায় সালাম দিয়ে, কেমন আছি জানতে চাইলো। আমার গলা মনে হলো কেউ চেপে ধরে রেখেছে। শত চেষ্টা করে গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। মাথা ঝাঁকালাম। কে যেন রোকেয়াকে ডাকলো। রোকেয়া চলে যাওয়ার পর বহু জড়তায় চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। জয়া অপলক আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

 

- 'জানো জয়া, অনেক খুঁজেছিলাম তোমায়।'

 

- 'কোথায় খুঁজেছিলে আমায়!?'

 

- 'যেখানে যেখানে তোমার থাকার কথা ছিল। অমন করে হারিয়ে না গেলেও পারতে!'

 

জয়া বিস্ময়ের চোখে চেয়ে রইল।

 

যত সময় যাচ্ছে মনের ভেতর অজানা ভয়টা আরো বেশী জোরে লাফিয়ে উঠল। আচ্ছা যে ছেলেটার সাথে রাইসার বিয়ে হচ্ছে সে ছেলেটা আমার.......? না না তা হলে আমাকে দেখার পর জয়া কখনই এই বিয়ে হতে দিত না।তবে সে কোথায়?

 

- 'কি ব্যাপার আজ তোমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে অথচ দেখে মনে হচ্ছে তুমি বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছ। তোমাকে নিয়ে আমি আর পারিনা।'

 

....রোকেয়ার কোন কথাই আমার কানে যাচ্ছিল না।জয়াকে যেহেতু পেয়েই গিয়েছি, ভেতরে শুধু একটাই বাসনা সবকিছু জানতে চাই। আর মেয়েকে নিয়ে আমার কোন টেনশন নেই। জয়া ওকে ঠিক আদরেই রাখবে।

 

.

 

জয়াকে একা পাওয়া গেল না। বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল।

মেয়ে বিদায়ের সময় জয়ার দুচোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছিল।

 

রোকেয়া বার বার জয়াকে আর জয়ার বরকে বললো, ‘বয়স কম ভুল হলে যেন বুঝিয়ে দেয়।’

 

জয়া বললো, ‘ভরসা রাখতে পারেন। আমি কারো ভরসা নষ্ট করি না।’

 

জয়ার কথাটা কেমন যেন বুকে খুঁচা খেলো। মনে হলো কথাটা আমাকেই বলেছে। জয়াতো জানে না! আমি তার বিশ্বাস ভালোবাসা ভরসা কিছুই নষ্ট করিনি। সময় সব উলট পালট করে দিয়েছিল। এখনও মনে হয় হাত বাড়ালেই সেই দিনগুলো ছোঁয়া যায়।

 

.

 

জয়া থাকতো রোকেয়া হলে আর আমি শহীদুল্লাহ্ হলে।

ভীষন ভালোবাসতাম একজন আরেকজনকে। আমি

মফস্বলের স্কুল মাষ্টারের ছেলে। জয়ার সাথে রিলেশন হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সবসময় মাথায় কাজ করত জয়াকে আমার হারিয়ে ফেলতে হবে। আজ হোক কাল হোক।

 

জয়া প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। তারা কখনই আমার মত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে না। কিন্তু জয়া কথাটা মানতে চাইত না। সে বলত ও সব ম্যানেজ করে নিবে।

 

একদিন সন্ধ্যায় কলা ভবনের সামনের দিকটাকে হাত ধরে বসে ছিলাম দুজনই। আমি সেদিন সাহস করে বলে ফেলেছিলাম, "ভুলে যাও আমায়। তোমাকে আমার হতে দেওয়া হবে না কখনই। কেউ দিবে না।"

 

জয়া আমার কাঁধে মাথা রেখে বললো, "এই কাঁধে কারো মাথার ভার সইতে পারবে তুমি।"

 

- "এই বুকে কারো হাত সইতে পারবে তুমি।"

 

পলকেই জয়াহীন শূন্যতা অনুভব করতেই কেমন অবশ হয়ে আসল শরীরটা। কোনকিছু না ভেবে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরেছিলাম জয়াকে। তারপর সেদিন তাকে ভরসা দিয়েছিলাম কোনদিন ছেড়ে যাবো না। লাগে সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে বিয়ে করবো।

 

তারপর থেকে দিন দিন সম্পর্ক আরো গভীর হতে লাগল।সময় যেতে যেতে মনের ভেতরে জয়াকে হারানোর ভয়টা কেটে গেল। মনে হচ্ছিল জয়াকে চিরদিনের জন্য পেয়ে গেছি।

 

বন্ধু আকিব তার বাসায় আমাদের বারো তেরোজনের দলটাকে থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষ্যে পার্টির জন্য ডাকলো। সাড়ে বারোটার দিকে মোটামুটি সবাই চলে গেল।জয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, কারন এখন হলের গেট খুলবে না। তাছাড়া বর্তমান প্রভোস্ট একটু বেশীই বদমেজাজি।

 

আকিব ব্যাপারটা আচঁ করতে পেরে বললো, "আরে রাতের অর্ধেক সময়ত চলেই গেছে বাকি সময়টা এখানেই কাটিয়ে দে। জয়া আমার রুমে থাকবে আমি আর তুই বাবুর রুম শেয়ার করে নিবো।"

 

কোন উপায় না দেখে রাজী হলো জয়া। জয়া আর আমি ছাদে বসে ছিলাম রাত দুটো পর্যন্ত। শীতের রাতে ঠান্ডায় দুজন জমে গিয়েছিলাম। শীতের রাতের আলাদা একটা রুপ আছে। সবকিছুকে কুয়াশা এমনভাবে ঢেকে রাখে।

মনে হয় পৃথিবীর সবকিছুকে কুয়াশা বুকে নিয়ে রেখেছে।

এমন পরিবেশে জয়াকর পেয়ে নিজেকে অনেক সম্পূর্ন লাগছে। শীতের হীম হীম হাওয়া গায়ে লাগতেই ভালো লাগাটা আরে বেড়ে গেল।

 

বাসায় ডুকে দেখলাম আকিব আর বাবু রীতিমত নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জয়াকে রুমে দিয়ে 'গুড নাইট' বলে অনেক কষ্টে বের হতে যাচ্ছিলাম। জয়া হাত চেপে ধরলো চাপা স্বরে বললো, "ভয় লাগছে সকাল হতে আর দুই-তিন ঘন্টা এখানে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেই।"

 

আমারও ওকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। আমার সবসময়ই শীত বেশী লাগে। জয়া কম্বলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, "এটার নীচে পা ডুকিয়ে বসো।"

 

আমি কিছুক্ষন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ জেগে দেখি জয়া একই রকমভাবে বসে আছে। বললাম, 'ঘুমাবে না।' বললো, 'মাথা ব্যাথা করছে।' ওর কাছে গিয়ে দেখি হাত পা সব বরফ ঠান্ডা হয়ে আছে। 

 

তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে বুকে চেপে ধরলাম। আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠল। আমার ভারি নিঃশ্বাস বার কয়েক জয়ার মুখে লাগতেই জয়া আমায় আরো শক্ত করে চেপে ধরে ওর মুখ আমার বুকে ঘষতে লাগলো।

 

সমস্ত আত্মায় ভয়ংকর সুন্দর ভালো লাগা শিহরণ জেগে উঠলো। তারপর নিজের অজান্তেই শরীর একধাপ একধাপ

করে চূড়ান্ত ধাপে চলে গেলো। দুজনের একজনও শরীরকে বাঁধা দিলাম না। মনের ভেতর অপার্থিব এক উল্লাসের ধারা বয়ে গেল।

 

সকালবেলা আকিব অফিসে যাওয়ার জন্য দরজা নক করতেই দরফড়িয়ে উঠলাম, জয়াকে ডাকলাম। কিন্তু কোন সারা পেলাম না। আকিবের সাথে চোখ মিলাতে পারছিলাম না। ও কি বুঝলো জানি না। খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, "চাইলে সারাদিন এখানে কাটিয়ে যেতে পারিস।"

 

আকিব আর বাবু চলে গেলে। জয়াকে ডাকলাম কেমন যেন লজ্জা লজ্জা ভাব লাগছিল। জয়া চোখ খুলে উঠে বসলো। খোলা এলোমেলো চুলে ওকে সাংঘাতিক সুন্দর লাগছিল। ওকে দেখলে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ও অদ্ভুত ভালো লাগার ঘোরে ডুবে আছে। অনেক জড়তা মিশিয়ে ওকে বললাম, 

 

- 'সরি।'

- 'কেন?'

- 'কাল রাতের জন্য।'

 

অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি দিয়ে বললো,

- 'দেখো তোমায় আমি অনেক আগেই মনে মনে বিয়ে করে ফেলেছি। সো নো সরি।'

 

জয়া আমায় বললো,

- 'চল আজ আমরা খাতা কলমে বিয়ে করে ফেলি।'

 

আমি বললাম

- 'সবই করে ফেলেছি। এইটা অন্তত বাবা মায়ের জন্য থাক না বাকি...আমি তাদের একমাত্র ছেলে। বিয়ে নিয়ে বাবা মায়ের অনেক আশা। বাবা মা সহ সবাইকে নিয়ে এসে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করবো তোমায়।'

 

দশটা পেরিয়ে গেছে তবুও সূরুজ মিয়া কুয়াশার চাদর ঠেলে বেরিয়ে আসতে পারছে না। রিক্সা চলতে শুরু করলো। মনে হয় শৈত প্রবাহ শুরু হয়েছে। রতন মামার চায়ের টংটাকে দুইহাত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে না।

 

দোকানের সামনে নেমে গেলাম। ঠান্ডায় দুইহাত ঘষতে ঘষতে চা দিতে বললাম। রতন মামু চায়ে চিনি দিয়ে টুংটাং শব্দ করছে আর বলছে, "জয়া আপা আপনেগোর বিয়াতে কইলাম আমারে দাওয়াত দিবেন। আমি সেদিন স্পেশাল চা বানাইয়া নিয়া যাইমু আপনাগোর দুইজনের লাইগা।"

 

আমাকে অবাক করে জয়ন বলে উঠলো, "তাইলে আজকেই খাওয়ান।" রতন মামু জয়ার কথায় কৌতহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলো, "বিয়া কি কইরা লাইছেন???"

 

"নারে মামু। এই কথা কয় আপনার স্পেশাল চা খাওয়ার ধান্ধায়।"

 

জয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল গতরাত থেকে চলমান গোপন সুখের কথা পারলে সে চিৎকার করে বলে। চা শেষ করে জয়াকে হলে দিয়ে আসলাম। অনেক অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। জয়াকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। জয়া ভেজা চোখে তাকিয়ে ছিলো। কাছে গিয়ে বলেছিলাম, "আরে পাগলী আমরা বিকেলে আবার দেখা করবো।"

 

এর আগে কখনও জয়া এমন করেনি আমারও এত খারাপ লাগেনি কখনও। কারন দুজনে চাইলেই দেখা করতে পারতাম। সেদিনই জয়া আর আমার শেষ দেখা হয়েছিল। হয়তো মন নামক আজব জিনিষটা এই ব্যাপারটা ঠিকই টের পেয়েছিল।

 

ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। হলের দিকে হাঁটা ধরলাম। সমস্ত শরীরে জয়ার মিষ্টি পরশ লেগে আছে। এই মেয়েটাকে এত ভালোবাসি কেন? জয়া পাশে না থাকলে বড্ড বেশী শূন্য শূন্য লাগে।

 

সেদিন রুমের দরজা খুলে দেখলাম একটা ভাঁজ করা কাগজ পরে আছে। কাগজে জামিলের লেখাটা পড়ে জানলাম আমার দুলাভাই ভোরবেলা মারা গিয়েছে।

 

জামিল আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। সদরঘাটে ওর একটা ফোনফ্যাক্সের দোকান আছে। জরুরী কিছু হলে বাবা ওর কাছে ফোন করে খবর দেত। খবরটা শুনে উম্মাদের মত ছুটে গিয়েছিলাম বাড়িতে। তারপর একের পর এর বিপদের সামনাসামনি হতে থাকলাম।

 

(চলবে)...

 

গল্পঃ অবৈধ সন্তান

পর্বঃ_০১

--------------

(সবাই শেয়ার করবেন গল্পটা, আপনাদের সাড়া পেলে পরবর্তী পর্ব খুব তাড়াতাড়ি পোস্ট করবো, ধন্যবাদ)

No comments found